রসায়ন নিয়ে কিছু কথা

রসায়ন বিজ্ঞান হচ্ছে ভৌত বিজ্ঞানের ( Physical Science) এর একটি শাখা; অন্য আরেকটি শাখা হল পদার্থ বিজ্ঞান। রসায়ন মূলত অণু-পরমাণুর ধর্ম, কিভাবে পরমাণু রাসায়নিক বন্ধনের মাধ্যমে রাসায়নিক যৌগ গঠন করে, কিভাবে আবার এই যৌগগুলো একে অপরের সাথে ক্রিয়া-বিক্রিয়া করে, তাদের মধ্যকার আন্তঃআণবিক আকর্ষণ বল কিভাবে কাজ করে, কিভাবে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে নতুন যৌগ তৈরি হয়- এই ধরনের বিষয়াদি নিয়ে গবেষণা করে থাকে। এই কাজ যারা করে থাকেন তাদের আমরা বলি- “রসায়নবিদ”। রসায়নবিদেরা আণবিক ও পারমাণবিক স্তরে পদার্থ সম্পর্কে গবেষণা করেন এবং তাঁদের জ্ঞান দিয়ে কীভাবে বিভিন্ন ধরনের পদার্থ একে অপরের সাথে ক্রিয়া করে এবং এগুলি কীভাবে বিভিন্ন অবস্থায় রূপান্তরিত হয়, তা ব্যাখ্যা করতে পারেন। রসায়নবিদেরা পদার্থের পরিবর্তন সাধন করতে পারেন ও নতুন নতুন যৌগ সৃষ্টি করতে পারেন যেগুলোর মধ্যে পড়ে ঔষধ, বিস্ফোরক, প্রসাধনী ও খাদ্য।এছাড়া রাসায়নিক সংশ্লেষণ কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন শিল্পে বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক দ্রব্য উৎপাদন করা হয়।
পদার্থের প্রকারভেদ কিংবা গবেষণার সাদৃশ্য বিবেচনা করে রসায়নের বিভিন্ন শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রসায়নের প্রধান শাখাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-
জৈব রসায়ন – যে শাখায় জৈব যৌগ নিয়ে আলোচনা করা হয়,
 অজৈব রসায়ন – রসায়নের যে শাখায় অজৈব যৌগ নিয়ে আলোচনা করা হয়,
প্রাণরসায়ন, রসায়নের যে শাখায় জীবদেহের রাসায়নিক পদার্থ নিয়ে আলোচনা করা হয়,
ভৌত রসায়ন, এই শাখায় আণবিক পর্যায়ে শক্তির সাথে সম্পর্কযুক্ত রাসায়নিক ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করা হয়,
বিশ্লেষণী রসায়ন, এক্ষেত্রে পদার্থের বিশ্লেষণের মাধ্যমে তাদের গঠন, সংযুক্তি ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করা হয়।
সাম্প্রতিক কালে রসায়নের আরও অনেক নতুন শাখার উদ্ভব হয়েছে, যেমন-স্নায়ুরসায়ন, স্নায়ুতন্ত্রের রাসায়নিক গঠন নিয়ে এই শাখায় আলোচনা করা হয়।
মাঝে মাঝে অনেকেই  রসায়নকে “কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান” বলে থাকেন। এর কারণ রসায়ন বিজ্ঞানই একমাত্র বিজ্ঞান যা অন্য তিনটি প্রাকৃতিক বিজ্ঞান যেমন – পদার্থবিজ্ঞান, ভূ-তত্ত্ব এবং জীববিজ্ঞানের মধ্যে একটা সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে।
ইংরেজি “Chemistry” শব্দটির উৎপত্তির ইতিহাস নিয়ে বিভিন্ন প্রবীণ বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতভেদ ছিল। রসায়নের ইতিহাস একটি বিস্তৃত বিষয়। বলা চলে আগুন আবিষ্কারের পর থেকেই মানব সভ্যতার হাত ধরে এগিয়ে চলেছে রসায়ন। মধ্যযুগে ধাতুকে সোনায় পরিনত করতে পারার পদ্ধতি আবিষ্কারের প্রচেষ্টায় শুরু হয়  আলকেমি বিদ্যা। এই আলকেমি বিদ্যা হাজার বছর ধরে চর্চা করা হয়েছিল পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। আলকেমি এক রহস্যময় অধ্যায়। আলকেমির অর্থ হলো অপরসায়ন। আলকেমি শব্দটি আরবি ‘আল-কিমিয়া’ থেকে এসেছে। আলকেমি নিয়ে যারা গবেষণা করতেন তাদের বলা হয় আল কেমিস্ট। এদের গবেষণার মূলত দুটি ধারা আছে, এক পরমায়ু লাভ করা। দ্বিতীয়ত সস্তা ধাতুকে সোনায় রূপান্তরিত করা। এই ‘আল-কিমিয়া’ শব্দটি মূলত গ্রীকদের  χημία অথবা χημεία থেকে ধার করা হয়েছে যারা অর্থ ছিল “একসাথে মিশানো”; এখানেই শেষ নয়, χημία শব্দটি এসেছে Chemi বা Kimi শব্দ থেকে। Chemi বা Kimi ছিল মিশর এবং তার অধিবাসীদের আদিমতম নাম। বিজ্ঞানের ইতিহাসে আলকেমি (আরবি: الكيمياء, আল-কিমিয়া) দ্বারা একটি প্রাচীনকালে প্রকৃতির এক ধরনের অনুসন্ধান এবং জ্ঞানের দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক একটি শাখাকে বোঝায় যাতে জ্ঞানের সকল শাখার সকল উপাদানের একত্রীকরণের মাধ্যমে একটিমাত্র উচ্চতর মহান শক্তির অস্তিত্বের ধারণা করা হতো। অর্থাৎ রসায়ন, ধাতুবিদ্যা, পদার্থবিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান, জ্যোতিষ শাস্ত্র, সেমিওটিক্‌স, মরমিবাদ, আধ্যাত্মবাদ এবং শিল্পকলা এই সকল শাখার সকল উপাদান যে একক উচ্চতর শক্তির অংশ হিসেবে বিদ্যমান রয়েছে তার বিজ্ঞানই হল আলকেমি। মেসোপটেমিয়া, প্রাচীন মিশর, পারস্য, ভারত, চীন, প্রাচীন গ্রীস, রোম, মুসলিম সভ্যতা এবং সবশেষে ইউরোপে এই আলকেমির চর্চা হয়েছে। এ হিসেবে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত প্রায় ২৫০০ বছর ধরে আলকেমির চর্চা অব্যাহত ছিল। আমি আলকেমি নিয়ে বেশি গভীরতার দিকে যেতে চাচ্ছি না। শুধু আলকেমি নিয়ে লিখতে গেলেই ভূরি ভূরি লেখা হয়ে যাবে।

 

0 comments:

Post a Comment