Recent Post
Loading...

তীরে এসে তরি ডুবল ৮১ জনের

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।

প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সুপারিশকৃত ৮১ জন চূড়ান্ত নিয়োগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। একটি দৈনিকে প্রকাশিত তথ্যানুসারে তাঁদের মধ্যে ১৫ জনের অভিভাবকের মুক্তিযোদ্ধা সনদে ‘ঘাপলা রয়েছে’। আর অবশিষ্টরা নিয়োগ পাননি অনেকটা রাজনৈতিক বিবেচনায়। সেই দৈনিকটির তথ্যানুসারে, এসব প্রার্থীর পরিবারের কেউ কেউ বিএনপি বা জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে নিরাপত্তা প্রতিবেদনে জানা গেছে।

২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে ৩৫তম বিসিএস পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি জারি করে পিএসসি। আবেদন করেন ২ লাখ ৪৪ হাজার ১০৭ জন প্রার্থী। প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে মেধা ও প্রাধিকার কোটার ভিত্তিতে নিয়োগের সুপারিশ চূড়ান্ত হয়। সব প্রক্রিয়া শেষে গেল বছরের আগস্ট মাসে বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হয় ২ হাজার ১৭৪ জনকে। তাঁরা সবাই স্বাস্থ্য পরীক্ষায়ও উপযুক্ত বিবেচিত হয়েছেন বলে ধারণা করা যায়। তারপর শুরু হয় পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) কর্তৃক প্রার্থীদের সম্পর্কে তথ্যানুসন্ধান। পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধা পোষ্য কোটায় সুপারিশপ্রাপ্তদের যথার্থতা যাচাইয়ে সংশ্লিষ্ট করা হয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে। সেই মন্ত্রণালয়কে কাজটি এক মাসের মধ্যে করে দিতে বলা যেত। এটা সম্ভবও ছিল। সে ক্ষেত্রে বাদ পড়াদের স্থানে অন্য উপযুক্ত প্রার্থী থাকলে সুপারিশ করতে পিএসসিকে বলা যেত। খালি যেত না পদগুলো।

আর বাকি অন্যদের সম্পর্কে যতটুকু জানা যায়, ক্ষমতাসীন দলের ভিন্নমতাবলম্বী কোনো পরিবারের সদস্যদের নেতিবাচক তালিকায় নেওয়া হয়। অথচ যাচাই করার কথা ছিল সংশ্লিষ্ট প্রার্থী কোনো রাষ্ট্রবিরোধী বা অনৈতিক কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ আছে কি না, এ বিষয়টি। অনুসন্ধানকাজে এসবি ছাড়াও জেলা প্রশাসকদের সংশ্লিষ্ট করা হয়। এর আগের কয়েক বছর করা হয়েছে অন্য আরেকটি গোয়েন্দা সংস্থাকে। তখন দুই সংস্থার দুই রকম প্রতিবেদন হওয়ায় প্রথমে অনেকেই বঞ্চিত হয়েছিলেন। পরে জেলা প্রশাসকদের প্রতিবেদন নিয়ে চাকরি পান বেশ কয়েকজন প্রার্থী।

এ উপমহাদেশের সিভিল সার্ভিস বহু ধরনের সংস্কারের পরও ব্রিটিশ যুগের ধারাবাহিকতায় চলছে। এর নিয়োগ প্রক্রিয়াও তা-ই। ব্রিটিশ শাসনামলে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসসহ (আইসিএস) উচ্চতর পদে নিয়োগের জন্য পুলিশি তদন্তই যথেষ্ট বিবেচিত হয়েছে। তেমনি হয়েছে পাকিস্তান শাসনামলে। অবশ্য তখন প্রার্থী কম ছিলেন। আর তদন্তকারীরা অনেক আন্তরিকতার সঙ্গে প্রতিবেদন দিতেন দ্রুত। এতে মূলত প্রার্থীর স্বভাবচরিত্র, রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ইত্যাদি বিবেচনায় আসত। তবে পাকিস্তান শাসনামলে দেখা গেছে, সরাসরি সরকারবিরোধী ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন এমন অনেককেই নিয়োগের জন্য অযোগ্য বিবেচনা করা হয়নি। তাঁরা চাকরি পেয়েছেন। যোগ্যতা ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে করেছেন দায়িত্ব পালন। জানা যায়, তাঁদের পরিবারের সদস্যদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা টেনে আনা হয়নি কোনো ক্ষেত্রে। এমনকি স্বাধীনতার পর ১৯৯১ সালের আগ পর্যন্ত তা-ই দেখা গেছে। আর সে জন্যই বর্তমান সিভিল সার্ভিসের শীর্ষ স্তরে বেশ কয়েকজন সাবেক ছাত্রনেতা রয়েছেন। তাঁরা তো সব সরকারের সময়ই বিশ্বস্ত ও অনুগত ছিলেন। চাকরির ক্ষেত্রে আজকের মতো রাজনীতিকে টেনে আনা হতো না।

চাকরি কিন্তু একটি সাংবিধানিক অধিকার। আর সেই অধিকার অর্জন করতে রাষ্ট্রের নির্দিষ্ট মানদণ্ডে বিভিন্ন স্তরে পরীক্ষা দিয়ে একজন প্রার্থী নিয়োগের জন্য পিএসসির সুপারিশ পান। সে ক্ষেত্রে এ ধরনের তদন্ত আরও অনেক সুবিবেচনাপ্রসূত হওয়া সংগত। কারও কোনো নিকট বা দূরের আত্মীয় ভিন্ন কোনো দল করেন, তার জন্য তাঁকে চাকরি না দেওয়া বড় ধরনের অনৈতিক কাজ বলে বিবেচনা করা যায়। এমনকি সেই প্রার্থী ছাত্রজীবনে কোনো ছাত্র সংগঠন করলেও (হতে পারে সেটা সরকারের বিরোধী) তাঁকে চাকরির অধিকার থেকে বাদ দেওয়া যায় না। একমাত্র নাশকতা সৃষ্টির সুস্পষ্ট প্রমাণ আছে যাঁদের বিরুদ্ধে, আর আছে অনৈতিক কাজে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগ, তাঁদের ব্যাপার ভিন্ন। তবে ক্ষেত্রবিশেষে আবেগপ্রবণ কাজকে উপেক্ষা করা উচিত। অতীতে তা-ই করা হয়েছে।

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে যোগ দিতে এলে তা ছাত্রদের জোরালো প্রতিরোধে ভেস্তে যায়। সেই প্রতিরোধে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী এবং তখন গ্রেপ্তার হওয়া একজন ছাত্র এর কিছুকাল পরই সিএসপি হয়েছিলেন। সেই সরকারই বিশেষ বিবেচনায় নিরাপত্তা ছাড়পত্র দিয়েছিল তাঁকেও। কর্মজীবনে তিনি দীর্ঘকাল সরকারের শীর্ষ পদে ছিলেন। আজকের যে শীর্ষ আমলারা নীতিনির্ধারণ করেন, তাঁদের কেউ কেউ এগুলো জানেন। তাই দয়া করে জাতিকে আর বিভক্ত করার দায়ভার নেবেন না। একটি দেশে বিভিন্ন মতাদর্শ থাকবে। থাকবে নানা ঘরানার রাজনৈতিক দল। এদের মধ্যে কেউ সত্যিকারের রাষ্ট্রদ্রোহী হলে শুধু চাকরিবঞ্চিত নয়, তাঁকে সাজা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। দেশপ্রেম একটি বড় বিষয়। আমরা একা কেউ এর দাবিদার হতে পারি না। গুটি কয়েক ব্যক্তি বাদে ১৬ কোটি লোকেরই এ দাবি করার অধিকার আছে।
এ প্রসঙ্গে আরেকটি বহুল আলোচিত বিষয় থাকছে নিয়োগ প্রক্রিয়ার সময়কাল নিয়ে। আমরা দেখতে পাই, ২০১৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ৩৫তম বিসিএসের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছিল পিএসসি। তাদের পর্যায়ে সুপারিশ চূড়ান্ত করতে ২০১৬ সালের ১৭ আগস্ট পর্যন্ত সময় নেয়। পেশ করে সরকারের কাছে। এ ক্ষেত্রে দুই বছর সময় নিয়েছে পিএসসি। অথচ এ বিষয়ে অনেক নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে, বছরের পরীক্ষা বছরেই শেষ শুধু নয়, নিয়োগের পর্বও সম্পন্ন করতে হবে। এটা অত্যন্ত আনন্দের কথা যে পিএসসি এই দাবিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। তারা এক বছরের মধ্যে পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ থেকে নিয়োগের সুপারিশ করা পর্যন্ত এক বছর সময়ের একটি রোডম্যাপ করেছে। দীর্ঘকালের ঘুণে ধরা মানসিকতায় এখনো রোডম্যাপ বাস্তবায়ন করতে পারেনি। তবে সিদ্ধান্তে অবিচল থাকলে একপর্যায়ে সাফল্য না আসার কোনো কারণ নেই।

তা ছাড়া গেল মধ্য আগস্টে যে সুপারিশ এল, সরকারের পক্ষে তা চূড়ান্ত করে নিয়োগ দিতে সাড়ে সাত মাস সময় কেন লাগবে? আমরা বুঝতে পারি, তা লেগেছে নিরাপত্তা ছাড়পত্রের প্রয়োজনে। ভারত তো এটা প্রাপ্তি সাপেক্ষে সর্বভারতীয় ও কেন্দ্রীয় সরকারের পদস্থ চাকরিতে নিয়োগ দিয়ে দেয়। আমরা এখনো এরূপ চর্চা শুরু করিনি। তবে সুপারিশ পাওয়ার দুই মাসের মধ্যে নিয়োগের পর্ব সম্পন্ন করা যায়। আর তা নিরাপত্তা ছাড়পত্র নিয়েই। এমনটা করা হয়েছে অতি সাম্প্রতিক সময়েও। ২৭তম বিসিএসের পিএসসির সুপারিশ পাওয়ার পর নিয়োগের পর্ব সম্পন্ন হয়েছিল এ ধরনের সময়েই। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নথিই এর সাক্ষ্য দেবে। এই দ্রুততা প্রার্থী ও সরকার উভয়ের জন্য প্রয়োজন। সরকার জনবলের সংকটে যেন না ভোগে এবং প্রার্থীর জীবনের মূল্যবান সময় কাজে লাগানোর স্বার্থে আবশ্যক এমন দ্রুততা। তদুপরি যাঁরা নিয়োগ পাবেন না, তাঁরা পুনরায় প্রস্তুতি শুরু কিংবা অন্যত্র চেষ্টায় নিজেদের নিয়োজিত করতে পারবেন। আর এটা সম্ভব এবং অতীতে হয়েছে। প্রতিবেশী দেশগুলোতে এখনো হচ্ছে। সুতরাং আমাদেরও না পারার কথা নয়।

সবশেষে আসে মূল বিষয়টি। যেসব প্রার্থী গত তিন বছর এই পরীক্ষার পেছনে ছুটেছেন, সাফল্যের সঙ্গে অতিক্রম করেছেন একেকটি স্তর, তাঁদের এই পর্যায়ে এসে বাদ দিতে হলে অনেক সংবেদনশীল মন নিয়ে প্রতিবেদনগুলো পর্যালোচনা করা দরকার। প্রশাসনের শীর্ষে যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের জন্য এটা একটা পবিত্র দায়িত্ব। শুধু গতানুগতিক নথি নিষ্পত্তির মাধ্যমে এগুলো করা যায় না। জনপ্রশাসন কিন্তু যন্ত্র নয়। এটা পরিচালনা করে মানুষ। এখানে কিছু যন্ত্রের ব্যবহার আছে বটে; তবে অনেক বেশি ব্যবহার মস্তিষ্ক ও হৃদয়ের। গতানুগতিক ধারায় কাজ অনেক হয়েছে। মানুষের কল্যাণে একটু ব্যতিক্রমী হতে ক্ষতি কোথায়? আর ব্যাপারটা প্রকৃতপক্ষে ব্যতিক্রমও নয়। বরং ন্যায় প্রতিষ্ঠিত করা। এভাবেই চলছিল। মাঝখানে কিছুকাল ভিন্ন দিকে যাত্রা। সঠিক পথে ফেরানোর একটি কল্যাণকর উদ্যোগ কি নেওয়া যায় না? যাতে পিএসসির সুপারিশপ্রাপ্ত অবশিষ্ট প্রার্থীরা নিজেরা কোনো অন্তর্ঘাতমূলক বা অনৈতিক কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার সুস্পষ্ট অভিযোগ না থাকলে চাকরিটি পেতে পারেন।




0 comments:

Post a Comment