প্রথমে চলুন জেনে নেওয়া যাক ভর সংখ্যা ও পারমাণবিক সংখ্যা কি।
পারমাণবিক সংখ্যাঃ- পরমাণুর নিউক্লিয়াসে যতগুলো প্রোটন থাকে তাই তার পারমাণবিক সংখ্যা। একটি মৌলের সাথে আরেকটি মৌলের পার্থক্য এই পারমাণবিক সংখ্যায়। একে সাধারণত ইংরেজী Z বর্ণ দ্বারা প্রকাশ করা হয়ে থাকে।
ভর সংখ্যাঃ- পরমাণুর নিউক্লিয়াসে প্রোটন ও নিউট্রনের মোট সংখ্যাকে ভর সংখ্যা বলে। অর্থাৎ ভর সংখ্যা (A) = প্রোটন সংখ্যা (Z) + নিউট্রন সংখ্যা (N)। প্রোটন ও নিউট্রনের সংখ্যার এই যোগফলকে ভর সংখ্যা বলার কারণ পরমাণুর মোট ভরের প্রায় পুরোটার জন্যই তারাই দায়ী। ইলেকট্রনের ভর অতি নগণ্য। একটি ইলেকট্রনের ভর, একটি প্রোটনের ভরের প্রায় ১৮৩৭ ভাগের এক ভাগ। ঐদিকে প্রোটন ও নিউট্রনের ভর প্রায় সমান। তাই পরমাণুর ভর গণনায় ইলেকট্রনের ভরকে বাদ দেওয়া হয়।
এবার পর্যায় সারণির প্রথম কয়েকটি মৌলের পারমাণবিক সংখ্যা ও ভর সংখ্যা দেখা যাকঃ-
দেখতে পাচ্ছেন প্রথম বিশটি মৌলগুলোর মধ্যে কয়েকটি মৌলের ভর সংখ্যা পারমাণবিক সংখ্যার দ্বিগুণ। এর কারণ হচ্ছে, ঐসব মৌলগুলোর নিউক্লিয়াসে সমান সংখ্যক প্রোটন ও নিউট্রন রয়েছে। যেমন ম্যাগনেসিয়ামের কথাই ধরুন। এর পারমাণবিক সংখ্যা, Z = 12 এবং ভর সংখ্যা, A = 24. মৌলটির নিউক্লিয়াসে প্রোটন রয়েছে ১২টি এবং নিউট্রনও রয়েছে (২৪ - ১২ = )১২টি।
বাকি মৌলগুলোতে ব্যাপারটি এরকম না হলেও এদের ভর সংখ্যা পারমাণবিক সংখ্যার দ্বিগুণের কাছাকাছি। এই বাক্যটিকে এভাবেও বলা যায় - এইসব মৌলগুলোর নিউট্রন সংখ্যা প্রোটন সংখ্যার প্রায় সমান।
কিন্তু যতই পারমাণবিক সংখ্যা বাড়তে থাকে অর্থাৎ যতই আমরা পর্যায় সারণির শেষের দিকে অগ্রসর হতে থাকব ততই কিন্তু প্রোটন ও নিউট্রন সংখ্যার তারতম্য ঘটতে থাকে। ব্যাপারটিকে আমরা একটি চিত্রের মাধ্যমে উপস্থাপন করতে পারি।
চিত্র -১: নিউট্রন সংখ্যা বনাম পারমাণবিক সংখ্যা লেখ।[1]
লাল রংয়ের যে সরল রেখাটি দেখা যাচ্ছে সেটি, নিউট্রন সংখ্যা : প্রোটন সংখ্যা = ১ : ১ অনুপাত নির্দেশ করছে। লাল রংয়ের ফোটাগুলো একেকটি মৌলকে বোঝাচ্ছে। আর হালকা লাল রংয়ের অঞ্চলটি স্থিতিশীল মৌলগুলোর অবস্থান দেখাচ্ছে। খেয়াল করুন, প্রথম দিকে (পারমাণবিক সংখ্যা < 20) মোটামুটি সবগুলো ফোটাই সরলরেখার উপরে অবস্থিত অর্থাৎ এসব মৌলের নিউট্রন ও প্রোটনের অনুপাত ১:১।
কিন্তু যতই প্রোটন সংখ্যা বাড়ছে (অর্থাৎ উচ্চ পারমাণবিক সংখ্যা বিশিষ্ট মৌল) ততই এই অনুপাত লঙ্ঘিত হচ্ছে (বিন্দু গুলো আর সরলরেখার উপর থাকছে না)। এক্ষেত্রে নিউট্রনের সংখ্যা প্রোটন সংখ্যার চেয়ে বেশী হয়ে যাচ্ছে। যেমন- জিরকোনিয়াম (Zr) এর বেলায় পারমাণবিক সংখ্যা ৪০ এবং ভর সংখ্যা ৯০। ফলে এর নিউক্লিয়াসে নিউট্রন রয়েছে = ৯০ - ৪০ = ৫০ টি। এর নিউট্রন ও প্রোটনের সংখ্যার অনুপাত হয়ে যাচ্ছে ১.২৫ : ১। টিন (Sn) এর বেলায় এই অনুপাত ১.৪ : ১। পারদের বেলায় এটি আরও বেশী ১.৫ : ১।
কিন্তু কেন এমন হচ্ছে? কি জন্যে প্রোটন ও নিউট্রনের সংখ্যা সমান রইলো না? কেনই-বা শুধু নিউট্রন সংখ্যা বেশী হয়ে যাচ্ছে, কম হলো না কেন?
উত্তরটি দেবার আগে একটি উদাহরণ কল্পনা করা যাক। আপনি দুটি চুম্বক নিলেন। এবার চুম্বকগুলোর একই মেরু কাছাকাছি আনার চেষ্টা করছেন। কি হবে? আপনি এগুলোকে একজায়গায় রাখতে পারবেন না। ছেড়ে দেবার সাথে সাথে চুম্বকগুলো দূরে সরে যাবে। কারণ চুম্বকের সমমেরু একে অপরকে বিকর্ষণ করে। তবে এগুলোকে যদি একই জায়গায় এবং গায়ে গায়ে লাগিয়ে রাখতে চান, আপনাকে এবার বল প্রয়োগ করে জোড় করে চুম্বকগুলোকে ধরে রাখতে হবে যা এই বিকর্ষণ বলকে পরাভূত করবে।
এবার পরমাণুতে ফিরে আসা যাক। নিউক্লিয়াসে যে দুইটি কণা থাকে তার মধ্যে শুধু প্রোটনের আধান রয়েছে। অপরদিকে নিউট্রন হচ্ছে আধানহীন। আমরা জানি সমধর্মী আধান পরস্পরকে বিকর্ষণ করে থাকে ঠিক চুম্বকের সমমেরুর মতই। নিউক্লিয়াসের ছোট্ট জায়গায় প্রোটনগুলো যখন অবস্থান করে তখন এই কুলম্বের তড়িৎচৌম্বক বিকর্ষণ বল এদেরকে একত্রে থাকতে দিতে চায় না। উদাহরণে যেমন আপনার প্রয়োগকৃত বল দিয়ে চুম্বকগুলোর বিকর্ষণ বলকে দমিয়ে রেখেছিলেন এরকম কোনো বল যদি পরমাণুতে না থাকে তবে নিউক্লিয়াস তৈরী হতে পারবে না।
আশার কথা, এরকম একটি বল রয়েছে। সেটি হচ্ছে চারটি মৌলিক বলের আরেকটি - সবল নিউক্লিয় বল। যখন দুটি কণিকা একে অপরের খুব নিকটে আসে এই বল কাজ করে। আর এই বলটি আকর্ষণ ধর্মী এবং তা তড়িৎ চৌম্বক বলের চেয়েও শক্তিশালী। নিউট্রন গুলো নিজেদের সাথে এবং প্রোটনদের সাথে সবল নিউক্লিয় বলের মাধ্যমে নিউক্লিয়াসকে স্থিতিশীলতা দান করে। অনেকটা যেন আঠা দিয়ে নিউট্রনগুলো প্রোটনগুলোকে নিজেদের সাথে আটকিয়ে রাখে।
চিত্র-২: নিউক্লিয়াসের স্থিতিশীলতা।[2]
যখন নিউক্লিয়াসে প্রোটন কম থাকে তখন এদের মধ্যকার বিকর্ষণ বল কম থাকে। ফলে নিউক্লিয়াসের স্থিতিশীলতার জন্য নিউট্রনের সংখ্যাও কম থাকে। প্রতিটি প্রোটনের বিপরীতে একটি নিউট্রন হলে চলে যায়। তবে নিউট্রন সংখ্যা প্রোটনের চেয়ে কম হলে সেটি সম্ভব নয়। তাই নিউট্রন সংখ্যা সর্বদাই প্রোটনের সমান বা তার বেশী থাকতে হবে। (ব্যতিক্রমঃ হাইড্রোজেন পরমাণু। এখানে একটিমাত্র প্রোটন। তাই বিকর্ষণের প্রশ্ন আসে না। ফলে নিউট্রনেরও প্রয়োজন নেই)
এখন পরমাণুতে প্রোটন যত বাড়তে থাকে বিকর্ষণ বলের মানও তত বাড়তে থাকে। কিন্তু এবার প্রোটনের সমান সংখ্যক নিউট্রন দিয়ে নিউক্লিয়াসটিকে বেঁধে রাখা সম্ভব নয়। এর কারণ হলো তড়িৎ চুম্বক বল এর পাল্লা অনেক বড় (অসীম)। নিউক্লিয়াসের একটি প্রোটন তার দূরবর্তী প্রোটনের উপরও বিকর্ষণ বল প্রয়োগ করতে পারে অন্যদিকে সবল নিউক্লিয় বলের পাল্লা অনেক কম (১ ফেমটোমিটার)।[3] তাই একটি নিউট্রন শুধুমাত্র তার নিকটবর্তী প্রোটন ও নিউট্রনের উপর এই আকর্ষণ বল প্রয়োগ করতে পারে। তাই এই তড়িৎ চৌম্বক বিকর্ষণ বলটিকে মোকাবেলা করার জন্য প্রোটনের চেয়ে বেশী সংখ্যক নিউট্রনের প্রয়োজন পরে। একারণে পর্যায় সারণির শুরুতে পরমাণুর নিউক্লিয়াসে প্রোটন ও নিউট্রনের সংখ্যা সমান হলেও উচ্চ পারমাণবিক সংখ্যা বিশিষ্ট পরমাণুতে স্থায়িত্বের জন্য নিউট্রন সংখ্যা অনেক বেশী হয়।