শেরিল স্যান্ডবার্গ |
প্রথমেই সবাইকে প্রাণঢালা অভিনন্দন! আজ থেকে ২৩ বছর আগে তোমাদের মতো আমিও এখানে উপস্থিত ছিলাম, তোমাদের চেয়ারেই বসে ছিলাম। আর আজকে আমি তোমাদের সামনে তোমাদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দিতে এসেছি। অদ্ভূত তাই না?
জীবনের এই পর্যায়ে এসে তোমরা সবচেয়ে বেশি যে প্রশ্নের সম্মুখীন হবে সেটা হলো, জীবনের লক্ষ্য কী? তোমাদের লক্ষ্য জানার আগে আমার নিজের গল্প বলি। জীবনের লক্ষ্যের কথা বলতে গেলে প্রথমে একটা কথাই আমি বলবো, আমি আমার জীবনের শুরুতেই কোনো একটি নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গিতে আবদ্ধ করে ফেলিনি। আর সে কারণেই হয়তো আমার সাফল্যের দুয়ার খুলে গিয়েছে। তবে সাফল্যের মূলমন্ত্র হলো, সাফল্যের কোনো সহজ রাস্তা নেই। অনেক সময় জীবনে অনেক বড় বড় সুযোগও হয়তো তোমাদের হাতছাড়া হয়ে যাবে। তার জন্য আফসোস করোনা। তবে আমাদের সময়ের মতো এখন তোমাদের সাফল্যের জন্য অনেক বেশি কষ্ট করতে হবে না। তোমরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এক বিশাল সম্ভাবনার যুগে জন্মেছো, এর সুবিধা সম্পূর্ণরূপে ব্যাবহার করো।
সবসময় নিজের চারপাশে খেয়াল করো, দেখবে খুব সাধারণ কিছুতেই হয়তো অনেক বিশাল সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে। তবে আজকে আমি তোমাদেরকে যেই উপদেশ দিতে চাই, সেটা হলো সবসময় নিজেদেরকে সততার পথে রাখবে। অন্যের সাথে সৎ থাকার আগে নিজের সাথে সৎ হও, এই পৃথিবীর সাথে সৎ হও। আমি জানি একে অন্যের সাথে সৎ থাকা এখনকার দিনে কতটা কঠিন। অনেক সময় নিজের কাছের বন্ধু হওয়ার কারণে সৎ থাকা কিংবা কোনো ব্যাপারে সত্য কথা বলাটা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তবে আমি বলবো নিজের সবচেয়ে কাছের বন্ধুকেই সত্য কথা বলা উচিত। কারণ তুমিই জানো তোমার বন্ধু কিসে ভালো আর কিসে তার দুর্বলতা। তোমার সত্য তাকে আরও ভালো মানুষ হয়ে গড়ে উঠতে সাহায্য করবে। এটা সত্যি যে, নিজের সমালোচনা শোনা কখনই আনন্দের বিষয় নয়, তবুও এটাই নিজেকে উন্নত করার একমাত্র উপায়। আমাদের মূল সমস্যা এই যে, বেশির ভাগ সময়ই আমরা নিজেদেরকে কঠিন সত্য থেকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করি। আর এর চেয়ে ভয়ঙ্কর কিছু নেই। আজ থেকে আরও অনেক বছর আগে আমি যখন এখানে তখন ভাবতাম, আমার নারীবাদী হওয়ার প্রয়োজন নেই, কারণ আমরা সবাই সমান। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম এবং এখনও আমি ভুল। এই পৃথিবী কখনই সবার জন্য সমান নয়। আমার মনে হয় আমরা এখন শুধু সত্য থেকে নিজেদের লুকিয়ে বেড়াই তা নয়, আমাদের মধ্যে কোনো কিছু আশা করার সাহসও কমে গেছে। আমাদের কিছুদিন আগের নির্বাচনে ২০ শতাংশ আসন জিতে নেয় নারীরা। বিস্ময়কর ব্যাপার হলেঅ, মিডিয়া এই খবর প্রকাশ করতে লাগলো যে নারীরা বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলছে। আমি বলবো, যেই দেশে ৫০ শতাংশ নারী সেখানে ২০ শতাংশ মানুষ আসন পাওয়া মানে বিপ্লব নয় বরং বিব্রতকর। তাই আমার মনে হয়, আমাদের স্বপ্নগুলো ক্ষুদ্র, তাই প্রাপ্তিও কম।
আমাদের এখন দিন পরিবর্তনের সময়। আমাদের সত্য দেখার এবং জানার সময় এসেছে। আমরা সত্য লুকিয়ে রাখি আর ভাবি আমাদের অনেক উন্নতি হচ্ছে। চোখের সামনে আমরা বৈষম্য দেখি, কিন্তু কিছুই বলি না। হ্যাঁ আমরা একজন আফ্রো-আমেরিকান প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করেছি সেটা সত্য কিন্তু তারপরও আমাদের মধ্যে বৈষম্য রয়ে গিয়েছে কারণ আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এর বিষ রয়েছে। আমাদের এ থেকে বের হয়ে আসতে হবে। যেই কথাগুলো বললাম, তার সবগুলোই কিন্তু আমাদের সমস্যা। আর আমাদের সমস্যা আমরা ছাড়া কেউ বুঝবে না, কেউ সমাধান করতে আসবে না। আশা করি এটা আমরা কমবেশি সবাই বুঝি। এই সকল অসমতা নিয়ে আমি কথা বলা শুরু করেছি আজ থেকে মাত্র ৫ বছর আগে। আর তার আগে সমাবর্তনের পর থেকে পরবর্তী ১৮ বছর আমি আমার মুখ খুলিনি। আমার নীরবতার মানে বলে দেয় যে সব কিছু ঠিকঠাক চলছে কোনো সমস্যা নেই। এই চুপ থেকে সময় নষ্ট করা আমার জীবনের একটা বিশাল ভুল। আমি তোমাদের উপর তাই কিছুটা দায়িত্ব দিতে চাই। আমি চাই তোমরা আমার চেয়ে আরও ভাল কিছু করো। তোমরা আমার আগে সরব হও। মানবতার শক্তি কতটা প্রখর আমরা জানি আর তাই আজকের দিনে তোমাদেরকে মানবতার প্রতি সহনশীল হওয়ার আহ্বান জানিয়ে, সত্যের পথে আমন্ত্রণ জানিয়ে আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি। (২৮ মে ২০১৪ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী এবং ফেসবুকের বর্তমান সিওও শেরিল স্যাণ্ডবার্গ উপস্থিত সবার উদ্দেশ্যে এই বক্তব্য দেন।
0 comments:
Post a Comment