Recent Post
Loading...

গ্লুকোজ কি? গ্লুকোজ এর রসায়ন।



গ্লুকোজ (ইংরেজি:Glucose) বা দ্রাক্ষা-শর্করা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কার্বোহাইড্রেট যা শর্করার রাসায়নিক শ্রেণিবিভাগে একশর্করা বা মনোস্যাকারাইডের অন্তর্ভুক্ত। জীবন্ত কোষ গ্লুকোজকে শক্তি ও বিপাকীয় প্রক্রিয়ার একটি উৎস হিসেবে ব্যবহার করে। সালোকসংশ্লেষণ বা ফটোসিনথেসিস প্রক্রিয়ার অন্যতম প্রধান উৎপাদ হলো গ্লুকোজ ।সাধারণত এই গ্লুকোজ প্রাণী ও উদ্ভিদ কোষের শ্বাসক্রিয়ায় অন্যতম অপরিহার্য উপাদান হিসাবে ব্যবহৃত হয়। পাকা, মধু ও আধিকাংশ মিষ্ট ফলে গ্লুকোজ থাকে । রক্তে এবং বহুমূত্র রোগীর মূত্রে সামান্য পরিমাণে গ্লুকোজ আছে।
“গ্লুকোজ” গ্রিক শব্দ glukus (γλυκύς) থেকে উদ্ভূত হয়েছে, যার অর্থ “মিষ্টি” এবং "-ose" প্রত্যয়টি চিনি নির্দেশ করে। অ্যালডোহেক্সোজ চিনির দুইটি স্টেরিও সমাণু গ্লুকোজ নামে পরিচিত, যার মাত্র একটি (D-গ্লুকোজ ) জৈবিকভাবে সক্রিয়। এই গঠনটিকে অনেক সময় ডেক্সট্রোজ ("ডেক্সট্রোরোটেটরি" হতে উদ্ভূত) মনোহাইড্রেট অথবা বিশেষত খাদ্য শিল্পে সাধারণভাবে ডেক্সট্রোজ বলা হয়। এই নিবন্ধটিতে D-গঠনবিশিষ্ট গ্লুকোজ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, L-গ্লুকোজ কোষে জৈবিকভাবে বিপাকীয় ক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে না, যা গ্লাইকোলাইসিস নামে পরিচিত। গ্লুকোজ ভেঙ্গে পাইরুভেট অথবা ল্যাকটেডে পরিণত হয়েছে;এটা সহজে বোঝানোর জন্য "গ্লাইকোলাইসিস" শব্দটি ব্যবহার করা হয়।

গঠন

গ্লুকোজের অণুতে ছয়টি কার্বন পরমাণু থাকে, যার একটি অ্যালডিহাইড গ্রুপের অংশ। তাই শ্রেণীগতভাবে গ্লুকোজ একটি "অ্যালডোহেক্সোস"। দ্রবণে গ্লুকোজ অণু খোলা শিকল আকারে বা গোলাকার বলয়াকারে (সাম্যাবস্থায়) থাকতে পারে। গোলাকার গঠনটি ছয় পরমাণু বিশিষ্ট হেমিয়াসেটাল উৎপাদনের জন্য অ্যালডিহাইড কার্বন পরমাণু ও কার্বন-৫ হাইড্রক্সিল গ্রুপের মধ্যকার সমযোজী বন্ধনের ফল। কঠিন অবস্থায় গ্লুকোজ বলয়াকার আকার ধারণ করে। কারণ বলয়ের গঠনটি পাঁচটি কার্বন ও একটি অক্সিজেন পরমাণু ধারণ করে। গ্লুকোজের গোলাকার কাঠামোটিকে অনেক সময় গ্লুকোপাইরানোজ বলেও অভিহিত করা হয়। এই গঠনে প্রত্যেক পরমাণু একটি করে হাইড্রক্সিল গ্রুপের সাথে যুক্ত থাকে, শুধু পঞ্চম পরমাণুটি ব্যতীত যা বলয়ের এর বাইরে ষষ্ঠ পরমাণুর সাথে যুক্ত থাকে এবং CH2OH গ্রুপ গঠন করে। গ্লুকোজ সাধারণত সাদা পাউডার বা ক্ষুদ্রাকার কঠিন স্ফটিক আকারে পাওয়া যায়। এটি জলে দ্রবীভূত হতে পারে। জলে এর দ্রাব্যতা খুব বেশী।

ধর্ম

গ্লুকোজ একটি মিষ্টি স্বাদযুক্ত দানাদার বা স্ফটিকাকার পদার্থ।। জলে দানায়িত করলে গ্লুকোজের প্রতি অণুতে একটি করে জলের অণু থাকে এবং এই জলযুক্ত গ্লুকোজের গলনাঙ্ক ৮৬° সেলসিয়াস । অনার্দ্র গ্লুকোজের গলনাঙ্ক ১৪৬° সে.। এটি জলে অত্যন্ত দ্রবণীয়। অ্যালকোহলে সামান্য দ্রবণীয়, ইথারে অদ্রবণীয়। এটি চিনির চেয়ে কম মিষ্ট। গ্লুকোজের অণুতে একটি –CHO মূলক এবং ৫টি OH থাকায় এটি অ্যালডিহাইড ও অ্যালকোহল উভয়ের মতো আচরণ করে।

প্রস্তুতি

গবেষণাগারে প্রস্তুতি

গবেষণাগারে অ্যালকোহলের উপস্থিতিতে চিনিকে HCl বা H2SO4 দ্বারা আর্দ্র বিশ্লেষিত করে গ্লুকোজ প্রস্তুত করা যায়। অ্যালকোহলে গ্লুকোজ অপেক্ষা ফ্রুক্টোজ অধিক দ্রবণীয় হওয়ায় দানায়ন পদ্ধতিতে গ্লুকোজ পৃথক করার জন্য দ্রাবক হিসাবে অ্যালকোহল ব্যবহৃত হয়। একটি পাত্রে ৪ সি সি গাঢ় HCI ১০০ সি সি ৯০% ইথাইল অ্যালকোহল এবং ৪০ গ্রাম চূর্ণ চিনি নিয়ে ৫০ উষ্ণতায় গরম করা হয়। পাত্রটিকে মাঝে মাঝে ঝাঁকানো হয় যে পর্যন্ত না চিনি সম্পূর্ণরূপে দ্রবীভূত হয়। এতে করে চিনি আর্দ্র-বিশ্লেষিত হয়ে গ্লুকোজ ও ফ্রুক্টোজ তৈরি হয়। ম্রিশ্রণটিকে ঠাণ্ডা করে এতে কেলাসনের সাহায্য করার জন্য কিছু গ্লুকোজের দানা যোগ করলে কম দ্রবণীয় গ্লুকোজ দানায়িত হয় এবং দ্রবণে ফ্রুক্টোজ থেকে যায়। এই গ্লুকোজকে ছেঁকে পৃথক করার পর অ্যালকোহলে পুনরায় দানায়িত করলে প্রায় বিশুদ্ধ গ্লুকোজ পাওয়া যায়।
C12H22O11 + H20 = C6H12O6 (গ্লুকোজ) + C6H12O6 (ফ্রুক্টোজ)

শিল্পক্ষেত্রে প্রস্তুতি

শিল্পক্ষেত্রে স্টার্চ বা শ্বেতসার জাতীয় দ্রব্যকে পাতলা এসিড দিয়ে ভেজালে গ্লুকোজ তৈরি হয়। চাল, আলু, ভুট্টা প্রভৃতি শ্বেতসার জাতীয় দ্রব্য অতিরিক্ত জল ও পাতলা H2SO4-এর সঙ্গে উচ্চ চাপে উত্তপ্ত করলে তা আর্দ্রবিশ্লেষিত হয়ে গ্লুকোযে পরিণত হয়। সোডিয়াম কার্বনের দ্বারা অতিরিক্ত এসিড প্রশমিত করার পর মিশ্রণটি ছেকে নেওয়া হয়। পরিশ্রুত দ্রবনকে সক্রিও কয়লা দিয়ে বর্ণহীন করে তাপে গাঢ় করলে ঠাণ্ডা করলে দানার আকারে গ্লুকোজ পৃথক হয়ে যায়। এই গ্লুকোজে সামান্য পরিমাণে মল্টোজ ও ডেক্সট্রিন থাকে। মিথাইল অ্যালকোহলে আবার দানায়িত করলে প্রায় বিশুদ্ধ গ্লুকোজ পাওয়া যায়।
(C6H10O5)n + nH2O → nC6H12O6

সমাণু

অ্যালডোহেক্সোস চিনির চারটি কাইরাল কেন্দ্র রয়েছে যা 24 = 16 টি স্টিরিওসমাণু তৈরি করে। এগুলো দুইটি গ্রুপে বিভক্ত হয়, L ও D, যার প্রত্যেকটিতে আটটি চিনি থাকে। গ্লুকোজ এদের অন্যতম চিনি এবং L-গ্লুকোজ ও D-গ্লুকোজ হল দুইটি স্টিরিওসমাণু। এদের মধ্যে মাত্র সাতটি জীবন্ত উদ্ভিদে বা প্রাণীতে পাওয়া যায়। D-গ্লুকোজ, D-গ্যালাকটোজ, D-ম্যানোজ এদের মধ্যে সবচেয়ে গরত্বপূর্ণ। এই আটটি সমাণু ডায়াস্টেরিও সমাণুর সাথে সম্প্ররকিত এবং D-সিরিজের অন্তর্ভুক্ত। গ্লুকোজ যখন বৃত্তাকারে বিন্যস্ত হয়ে দুইটি গোলাকার গঠনবিশিষ্ট অ্যানোমার, α- গ্লুকোজ ও β-গ্লুকোজ তৈরি করে তখন কার্বন-১ এ অতিরিক্ত একটি অপ্রতিসম কেন্দ্র (অ্যানোমারিক কার্বন পরমাণু) সৃষ্টি হয়। গঠনের দিক থেকে C-১ ও C-৬ এর সাথে যুক্ত হাইড্রক্সিল গ্রুপের আপেক্ষিক অবস্থানের সাথে এই অ্যানোমারগুলোর পার্থক্য রয়েছে। যখন D-গ্লুকোজ ত্রিমাত্রিকভাবে (হাওয়ারথ অভিক্ষেপণ) বা শিকল কাঠামো আকারে উপস্থাপন করা হয় তখন α নির্দেশ করে যে, C-১ এর হাথে যুক্ত হাইড্রক্সিল গ্রুপটি ট্রান্স সমাণু হিসেবে আছে; অপরদিকে β নির্দেশ করে যে এটি সিস সমাণূ হিসেবে আছে।