হিপনোটিজম কিভাবে কাজ করে? এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কী?

 এই ঘড়ির দিকে তাকিয়ে থাকুন… ঘড়িটা নড়ছে…

ধীরে ধীরে কল্পনা করুন আপনি এমন কোথাও আছেন যেখানে আপনার আশেপাশে কেউ নেই। আপনি মনকে ধীরে ধীরে শান্ত করুন… আপনি হাঁটছেন ধুধু মরুভূমির মাঝে। বালির উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন কিন্তু গরম অনুভূত হচ্ছে না! আপনি শান্তভাবে হেঁটে যাচ্ছেন। আপনার মনে অন্য কোন কিছুই আর ঘুরপাক খাচ্ছে না… আপনার মনের ব্যথা কমছে…

থাক… এভাবে অনেক কিছুই বানিয়ে বলতে পারবো আর গল্প শুরু করলে চলতেই থাকবে! 😁 অনেকেই সম্মোহন বলতে এমন কিছুই বোঝেন। সিনেমাতেও এমন কিছুই দেখানো হয়। আসলে ব্যাপারটা তেমন না।


👉সম্মোহন বা হিপনোসিস হল প্রস্তাবনা, তীব্র আবেগ ও কল্পনা শক্তি দ্বারা অন্যের মনকে প্রভাবিত করা এবং পরিচালনা করা।

এটি এক ধরনের চরম প্রস্তাবনা, শিথিলতা এবং তীব্রতার কল্পনা শক্তির দ্বারা একটি অস্বাভাবিক স্বপ্নায়ন মোহগ্রস্তের অবস্থার বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে। যা অনেকটা ঘুমের মত মনে হলে আসলে ঘুম নয়। কারণ বিষয়টি পুরো সময়জুড়ে সজাগ থাকে। অধিকাংশ সময় একে দিবা স্বপ্নের মত মনে হয়। হিপনোসিস চলাকালীন সময়ে মস্তিষ্কের সচেতন অংশকে সাময়িকভাবে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ঐ ব্যক্তির বিক্ষিপ্ত চিন্তাগুলোকে কেন্দ্রীভূত করা হয় এবং তাকে রিলাক্স করার দিকে মনোনিবেশ করা হয়। যখন আমাদের মন কোন একটি দিকে নিবিষ্ট হয়, কেন্দ্রীভূত হয় তখনই আমরা শক্তি অনুভব করি।

ধরুন, আপনি বই পড়ছেন, পড়তে পড়তে এমন অবস্থা হলো আপনি তার মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেললেন…আশেপাশে কি ঘটছে তার কোনো খেয়াল আপনার নেই। বইয়ের প্রতিটি চরিত্রের সাথে মিশে গেলেন। সম্মোহনের ব্যাপারটা তেমনই, আপনার মনকে অন্যান্য চিন্তা থেকে সরিয়ে একটা নির্দিষ্ট দিকে নিয়ে আসা হয়। এটা নাকি নিজে নিজের উপরও করা যায়!!

সেরিব্রাল কর্টেক্স জার্নালে প্রকাশিত ২০১৬ সালের গবেষণা হিসাবে, একটি সম্মোহিত মস্তিষ্কের তিনটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে।

  • প্রথমত, ডোরসাল এন্টিরিয়র সিঙ্গুলেটের কার্যকলাপ হ্রাস পায়, যা জ্ঞান এবং মোটর নিয়ন্ত্রণে জড়িত একটি অঞ্চল।
  • দ্বিতীয়ত, ডোরসোলেটারাল প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স এবং ইনসুলার মধ্যে সংযোগ বৃদ্ধি পায়, যা একটি মস্তিষ্ক-দেহের সংযোগ গঠন করে যা মস্তিষ্কের প্রক্রিয়া এবং শরীরে কী ঘটছে তা নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে।
  • অবশেষে, ডোরসোলেটারাল প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স এবং ডিফল্ট মোড নেটওয়ার্কের মধ্যে সংযোগ হ্রাস করা হয়, যা সম্ভবত একজন ব্যক্তির কর্ম এবং সেই কর্মগুলির সচেতনতার মধ্যে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার ইঙ্গিত দেয়।

এটা কি প্লাসিবো ইফেক্ট?

সম্ভবত… কিন্তু সম্মোহনের সময় মস্তিষ্কের কার্যকলাপে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য দেখা যায়। এটি বোঝায় যে মস্তিষ্ক সম্মোহনের প্রতি একটি অনন্য উপায়ে প্রতিক্রিয়া জানায়, যা একটি প্লাসিবো প্রভাবের চেয়ে শক্তিশালী। নির্দেশিত কথোপকথন বা যে কোন ধরনের আচরণগত থেরাপি আচরণ এবং অনুভূতির উপর শক্তিশালী প্রভাব ফেলতে পারে।

ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকলে মনে হবে এটা ঘুরছে!

হিপনোসিস চলাকালীন সময়ে মস্তিষ্কের সচেতন অংশকে সাময়িকভাবে নিয়ন্ত্রনে নিয়ে ঐ ব্যক্তির বিক্ষিপ্ত চিন্তাগুলোকে কেন্দ্রীভূত করা হয় এবং তাকে রিলাক্স করার দিকে মনোনিবেশ করা হয়। যখন আমাদের মন কোন একটি দিকে নিবিষ্ট হয়, কেন্দ্রীভূত হয় তখনই আমরা শক্তি অনুভব করি। যখন কোন ব্যক্তি সম্মোহিত হয় তখন আমরা তার মাঝে কিছু শারীরিক পরিবর্তন ও লক্ষ্যনীয় হয়। যেমন তার নাড়ীর স্পন্দন ও কমে যায়, শ্বাস প্রশ্বাস ও কমে যায়। সেই সাথে তার মস্তিষ্কের আলফা স্তরে ঢেউ খেলতে থাকে। এই সময়ে ঐ ব্যক্তিকে কোন একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে বা বিশেষ কোন নির্দেশনা প্রদান করা হয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানে এর ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে।

অনেকে এটির প্রভাবে হালকা থেকে মাঝারি পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া অনুভব করতে পারে। যার মধ্যে রয়েছেঃ

  • মাথা ব্যাথা
  • তন্দ্রা
  • মাথা ঘোরা
  • পরিস্থিতিগত উদ্বেগ

চিকিৎসা বিজ্ঞানে এই বিদ্যাকে ব্যবহার করতেন ইংল্যাণ্ডের ডাক্তার এস ডেল। তিনি সম্মোহনের সাহায্যে রোগীকে ঘুম পাড়িয়ে দাঁত তুলতেন, ছোটখাট অপারেশনও করতেন। কিন্তু তারপরেও অনেক ডাক্তারই এর ব্যবহার নিয়ে নিশ্চিত নন। তারা এটার ব্যবহার করতে নিষেধ করেন।

যেহেতু এর ব্যবহার চিকিৎসা বিজ্ঞানে হচ্ছে তাই বুঝতে পারছেন বিজ্ঞানে এর গ্রহনযোগ্যতা আছে।

ব্রিটিশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃক নিযুক্ত একটি কমিটি বিস্তর অনুসন্ধানের পর রায় দেয় হিপনোটিজম একটি বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি। এরপর যত দিন এগিয়েছে তাবড়-তাবড় চিকিৎসক-বিজ্ঞানীরা এই বিদ্যাটির বিষয়ে অত্যুৎসাহী হয়ে পড়েছেন। সেইসঙ্গে শুরু হয়েছে নিত্যনতুন গবেষণা। অতএব এটা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে সম্মোহন বা হিপনোটিজম একটা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। পৃথিবীতে অনেককিছুই যুক্তিযুক্ত ভাবে ঘটে কিন্তু মানুষের ঘটে সরাসরি সেই যুক্তি খুব সহজেই পৌছেনা বলেই সময় নিয়ে সেটা গবেষণা করে যুক্তি বের করে নয়ত, দৈব কোনকিছু বলে ছুড়ে ফেলে দেয়। জেনে রাখুন, হিপনোটাইজড সবাইকেই করানো সম্ভব। অনেকে মনে করেন, প্রবল ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন মানুষকে হিপনোটাইজ করা যায় না। এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা। হিপনোথেরাপি পদ্ধতি খুব সহজ।অবশ্য হিপনোথেরাপির আসল জোর মোটেই পদ্ধিতে নয়, সাজেশনে। হিপনোথেরাপির উদ্দেশ্য কাউকে হিপনোটাইজ করা নয়, রোগীকে তাঁর সমস্যা থেকে উদ্ধার করা। হিপনোথেরাপি হল “প্রোগ্রামিং অফ সাবকনসাস মাইন্ড”। এটা অনেক দ্রুত পদ্ধতি, যা কিনা সমস্যার মূলে সরাসরি হিট করতে পারে। তবে সাজেশন ঠিকঠাক না-হলে মনের প্রোগ্রামিংয়ে হয়ে যেতে পারে। কারও কারও ক্ষেত্রে একটা-দুটো অতিরিক্ত শব্দ গ্রহণ বা বর্জন সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে। অতএব যথেষ্ট অভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষিত হিপনোথেরাপিস্ট ছাড়া অন্য কারও কাছে থেরাপি নেওয়া উচিত নয়। বহু রকমের অসুখ-বিসুখ সারানো সম্ভব হিপনোথেরাপির মাধ্যমে। সারানো যায় বললে কম বলা হয়, বলা উচিত এক্কেবারে নির্মূল করা যায়, তাও বিনা ওষুধে। [1]

সম্মোহন কি কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে?

  • দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা অবস্থার চিকিত্সা যেমন রিমিটয়েড আর্থ্রাইটিস
  • শিশুর জন্মের সময় চিকিত্সা এবং ব্যথা হ্রাস
  • ডিমেনশিয়া এর উপসর্গ হ্রাস
  • ADHD এর নির্দিষ্ট লক্ষণগুলির জন্য হাইপোথেরাপি সহায়ক হতে পারে
  • কেমোথেরাপি চলাকালীন ক্যান্সার রোগীদের মধ্যে বমি বমি ভাব ও বমি বমি ভাব
  • ডেন্টাল পদ্ধতির সময় ব্যথা নিয়ন্ত্রণ
  • ওয়ারস এবং সেরিয়াসিসসহ ত্বকের অবস্থার অবসান বা হ্রাস
  • তিক্ত আন্ত্রন সিন্ড্রোম সঙ্গে উপসর্গ অ্যাসোসিয়েশন নির্মূল
  • মানুষের আচরণ পরিবর্তন যেমন, ধূমপান ত্যাগ, ওজন হ্রাস, বা বিছানা ভেজা প্রতিরোধ হিসাবে মানুষের সাহায্য করা।

সম্মোহন মামুলি ব্যাপার না। ভিডিওটা দেখলে বুঝবেনঃ

তো এ পর্যন্তই। উত্তরটা কিছুটা বড় হয়ে যাওয়ায় আমি নিজেই হিপনোটাইজের কবলে পড়লাম-

0 comments:

Post a Comment