রাসায়নিক শক্তি
আমরা জেনেছি যে, কোনো যৌগে মৌলসমূহ তাদের মধ্যে পারস্পরিক শক্তি দ্বারা যুক্ত থাকে। মৌলসমূহের একে অপরের সাথে যুক্ত হওয়ার শক্তিই হলো রাসায়নিক বন্ধন। তাছাড়াও কোনো পদার্থের অণু বা আয়নসমূহ একে অপরের সাথে নানা শক্তির সমন্বয়ে গঠিত ‘আন্তঃআণবিক শক্তি’ নামক শক্তির মাধ্যমে কাছাকাছি থেকে একটি নির্দিষ্ট অবস্থা, যেমনঃ কঠিন, তরল বা বায়বীয় অবস্থার সৃষ্টি করে। কোনো দ্রবের অণু বা আয়নসমূহের মধ্যে আন্তঃআণবিক শক্তি বেশি হলে কঠিন, কম হলে তরল ও আরও কম হলে- বায়বীয় অবস্থার সৃষ্টি হয়। তাহলে একই দ্রবের অবস্থাভেদে আন্তঃআণবিক শক্তি ভিন্নতর হয়। যেমন বরফ, পানি ও জলীয়বাষ্প হলো পানির কঠিন, তরল ও বায়বীয় অবস্থা। পানিকে তাপ (শক্তি) দিলে জলীয়বাষ্পের সৃষ্টি হয়, অর্থাৎ পানি তাপ শোষণ করে তরল থেকে বায়বীয় পদার্থে পরিণত
হয়। আবার পানিকে ঠাণ্ডা করলে, অর্থাৎ পানি থেকে তাপ বের করে নিলে পানি কঠিন (বরফ) দ্রবে পরিণত হয়।
অন্যদিকে, রাসায়নিক বন্ধন তৈরির সাথেও শক্তি জড়িত। ভিন্ন যৌগে অণুসমূহ ভিন্ন বন্ধনশক্তি দ্বারা যুক্ত থাকে। যদি বিক্রিয়ায় উৎপন্ন যৌগের মোট শক্তি বিক্রিয়কসমূহের মোট শক্তির চেয়ে কম হয় অথবা বেশি হয় তাহলে কী হতে পারে চল ভেবে দেখা যাক। উৎপন্ন যৌগে মোট শক্তির পরিমাণ কম হলে বিক্রিয়ার ফলে শক্তির উদ্ভব হবে, এবং বেশি হলে শক্তির শোষণ ঘটবে।
মোটকথা, যে কোনো রাসায়নিক পরিবর্তনে কমবেশি শক্তির উদ্ভব বা শোষণ হয়ে থাকে, যদিও তা সবসময়ই আমরা অনুভব করতে পারি না। তাহলে এটা স্পষ্ট যে, দ্রবের অবস্থার পরিবর্তনের সাথে যেমন শক্তি জড়িত, রাসায়নিক বিক্রিয়ায় মাধ্যমে নতুন পদার্থে পরিণত হবার প্রক্রিয়ার সাথে তেমন শক্তি জড়িত।
তাপ উৎপাদী বিক্রিয়া
যে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় তাপ উৎপন্ন হয় তাকে তাপ উৎপাদী বিক্রিয়া বলে। যেমন: কাঠ, কয়লা বা গ্যাস
পোড়ালে তাপ উৎপন্ন হয়। কাঠ বা কয়লা মূলত কার্বন এবং কার্বনের বিভিন্ন যৌগ, যা দহনের মাধ্যমে বায়ুর অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও তাপ উৎপন্ন করে। চুন পানিতে দিলে তাপ উৎপন্ন হয়। চুন হলো ক্যালসিয়াম অক্সাইড, যা পানির সাথে বিক্রিয়া করে ক্যালসিয়াম হাইড্রক্সাইড; ও তাপ উৎপন্ন করে।
নির্গত তাপশক্তি = উৎপাদ যৌগসমূহের মোট শক্তি − বিক্রিয়ক যৌগসমূহের মোট শক্তি ()
তাপহারী বিক্রিয়া
যে রাসায়নিক বিক্রিয়া সংঘটিত হওয়ার জন্য তাপের শোষণ ঘটে, তাকে তাপহারী বিক্রিয়া বলে। খাবার সোডা ও লেবুর রস বা ভিনেগারের বিক্রিয়ার সময় তাপের শোষণ ঘটে। খাবার সোডা হলো সোডিয়াম-বাই-কার্বনেট। অপরদিকে লেবুর রসে সাইট্রিক এসিড ও ভিনেগারে এসিটিক এসিড থাকে। সোডিয়াম-বাই-কার্বনেট এসিডের সাথে বিক্রিয়ায় কার্বন-ডাইঅক্সাইড, লবণ ও পানি উৎপন্ন করে। বিক্রিয়াটি সংঘটিত হওয়ার সময় দ্রবণ থেকে তাপ শোষণ করে, ফলে আমরা দ্রবণটি ঠাণ্ডা হতে দেখি।
বিক্রিয়ায় তাপের পরিবর্তনের হিসাব
বিক্রিয়ায় তাপের পরিবর্তন = পুরাতন বন্ধন ভাঙার জন্য মোট শক্তি - নতুন বন্ধন গঠিত হওয়ার সময় নির্গত মোট শক্তি
তাপের পরিবর্তন ঋণাত্বক হলে বিক্রিয়া তাপউৎপাদী এবং ধনাত্বক হলে বিক্রিয়া তাপহারী ।
রাসায়নিক শক্তি থেকে তাপ ও বিদ্যুৎ
জ্বালানির দহনের ফলে উৎপন্ন পদার্থের অণু গঠনে ব্যয়িত শক্তি জ্বালানির অণুর মধ্যে স্থিত শক্তির তুলনায় কম । ফলে অতিরিক্ত শক্তি তড়িৎ চূম্বক তরঙ্গ হিসেবে চারিদিকে ছড়ায় যা আমরা তাপ ও আলো হিসাবে দেখি ও অনুভব করি ।
বিশুদ্ধ জ্বালানি
যা পোড়ানোর ফলে স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক পদার্থ তৈরী হয় না তাকে বিশুদ্ধ জ্বালানি বলে ।
শক্তির উৎস
সব শক্তির উৎস হলো - সূর্য । পরোক্ষভাবে রাসায়নিক শক্তির উৎস-ও সূর্য ।
জ্বালানীর নেতিবাচক প্রভাব
বায়ুর অন্য উপাদানের সাথে বিক্রিয়া করে না, তবে গ্যাসের তাপ ধারণক্ষমতা বেশি, অর্থাৎ তাপ শোষণ করে তা ধরে রাখতে পারে । আবার গ্যাস ওজনে ভারী হওয়ায় পৃথিবীপৃষ্ঠের কাছাকাছি অবস্থান করে। এতে করে দিনে দিনে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে, যাকে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বলা হয়। গ্যাসের এ ধরনের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ঘটনা ‘গ্রিন হাউজ প্রভাব’ বলে পরিচিত এবং -কে গ্রিনহাউজ গ্যাস বলা হয়। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে মেরুঅঞ্চলের বরফ গলে পানিতে পরিণত হয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত বন্যার সৃষ্টি করছে। অন্যদিকে, জ্বালানি পোড়ানোর ফলে উদ্ভূত অন্যান্য গ্যাসসমূহ নানারকম রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটিয়ে বায়ুকে দূষিত করছে এবং বায়ুতে বিভিন্ন উপাদানের ভারসাম্য নষ্ট করে এসিডবৃষ্টি ও ফটোক্যামিক্যাল ধোঁয়ার সৃষ্টি করছে। তাছাড়াও এসব গ্যাস ওজোনস্তরের সাথে সরাসরি বিক্রিয়া করে এর পুরুত্ব কমিয়ে দিচ্ছে বা ওজোনস্তরে ক্ষতের সৃষ্টি করছে। আসলে ওজোনস্তর সূর্যের আলোর ছাঁকনি হিসেবে কাজ করে সূর্যের আলোতে উপস্থিত অতিবেগুনি রশ্মি পৃথিবীতে আসতে বাধা প্রদান করে।
ইথানল জ্বালানী হিসাবে
ইথানল, যার অপর নাম ইথাইল অ্যালকোহল এটি একটি দাহ্য তরল রাসায়নিক পদার্থ। খনিজ জ্বালানি যেমন কেরোসিন, পেট্রোল, ডিজেল প্রভৃতির মতো ইথানলকে পোড়ালে তাপ উৎপন্ন হয়। তাহলে খনিজ জ্বালানির মতো ইথানলকে তাপ ইঞ্জিনের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে কলকারখানা, গাড়ি, বিমান, জাহাজ প্রভৃতি চালানো যেতে পারে। ব্রাজিল, উত্তর আমেরিকাসহ উন্নত দেশসমূহে ইথানলকে পেট্রোলিয়াম (খনিজ জ্বালানি) -এর সাথে মিশ্রিত করে তাপ ইঞ্জিনে ব্যবহার করা হয়। আমেরিকার মোটামুটি সব কারগাড়ি পেট্রোলের সাথে শতকরা ১০ ভাগ ইথানলমিশ্রিত জ্বালানি ব্যবহার করে রাস্তায় চলাচল করছে। ব্রাজিলের সরকার খনিজ জ্বালানির সাথে শতকরা ২৫ ভাগ ইথালন মিশ্রিত করে ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক করেছে। এছাড়াও আধুনিককালের ও পরবর্তী প্রজন্মের ব্যবহারযোগ্য শক্তি উৎপাদনের প্রযুক্তি বলে খ্যাত ‘ফুয়েল সেল’ (Fuel cell) -এর জ্বালানি হিসেবে অ্যালকোহল (মিথানল ও ইথানল) ব্যবহৃত হচ্ছে।
ইথানল উৎপাদন
ইথানল হলো একটি জৈব রাসায়নিক যৌগ, যা শ্বেতসার জাতীয় শস্য দানা যেমন আলু, ভুট্টা, ইক্ষু প্রভৃতি থেকে গাজন প্রক্রিয়ার (Fermentation reaction) মাধ্যমে উৎপন্ন করা যায়। এজন্য ইথানলকে জৈব জ্বালানি (Bio-fuel) বলা হয়। অধুনা নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে সেলুলোজ (উদ্ভিদের দেহের উপাদান) থেকে ইথানল উৎপাদন করাও সম্ভব হয়েছে। অন্যদিকে, কৃষিকাজের মাধ্যমে শস্য ও উদ্ভিদ তথা ইথানলের নিয়মিতভাবে উৎপাদন নিশ্চিত করা সম্ভব। অতএব খনিজ জ্বালানির মতো ইথানল ফুরাবার ভয় নেই। তাহলে, ইথানলের বাণিজ্যিক উৎপাদন ও বিকল্প জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের প্রযুক্তি উদ্ভাবন একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।
তড়িৎ রাসায়নিক কোষ
গ্যালভানি (Luigi Galvani)ও ভোলটা (Alessandro volta) প্রথম রাসায়নিক শক্তিকে বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। গ্যালভানি ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে ও ভোলটা ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে আলাদাভাবে পরীক্ষার মাধ্যমে বুঝতে পারেন যে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘটা জারণ-বিজারণ বিক্রিয়ার মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা সম্ভব। মূলত তাদের আবিষ্কারের ফলেই আজ আমরা ব্যাটারি পেয়েছি। তাহলে, গ্যালভানিক কোষ যা ভোলটায়িক কোষ বলেও পরিচিত হলো এক ধরনের তড়িৎ রাসায়নিক কোষ যার মাধ্যমে রাসায়নিক শক্তি থেকে বিদ্যুৎশক্তি তৈরি করা যায়। অপরদিকে বিদ্যুৎশক্তি ব্যবহার করে তড়িৎ রাসায়নিক কোষের মাধ্যমে রাসায়নিক বিক্রিয়া সংঘটিত করা যায়। একে তড়িৎ বিশ্লেষণ বলা হয়। যে কোষে তড়িৎ বিশ্লেষণ করা হয় তাকে তড়িৎ বিশ্লেষ্য কোষ বলে। তড়িৎ রাসায়নিক কোষ বিভিন্ন ক্ষুদ্রাংশ, যেমন তড়িৎদ্বার, লবণ- সেতু ও তড়িৎ বিশ্লেষ্য দ্রবণ নিয়ে গঠিত ।
পরিবাহী
যে সকল পদার্থের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হতে পারে, তাদেরকে বিদ্যুৎ পরিবাহী বলে। আর যাদের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হতে পারে না, তাদেরকে অপরিবাহী বলে। ধাতু, কার্বন, গ্রাফাইট, গলিত লবণ ও এসিড, ক্ষার ও লবণের দ্রবণ প্রভৃতি বিদ্যুৎ পরিবাহী হিসেবে কাজ করে। বিদ্যুৎ পরিবহনের কৌশলের উপর ভিত্তি করে পরিবাহীকে দুইভাগে ভাগ করা যায়। যথা:- (১) ইলেকট্রনিক ও (২) তড়িৎ বিশ্লেষ্য পরিবাহী। যে সকল পরিবাহী ইলেকট্রন প্রবাহের মাধ্যমে বিদ্যুৎ প্রবাহিত করে তাকে ইলেকট্রনিক পরিবাহী বলে। যেমন সকল ধাতু ও গ্রাফাইট। বিদ্যুৎপ্রবাহ যদি পরিবাহীর আয়ন দ্বারা সাধিত হয়, ঐসব পরিবাহীকে তড়িৎ বিশ্লেষ্য পরিবাহী বলে। যেমন গলিত লবণ, এসিড, ক্ষার ও লবণের দ্রবণ।
তড়িৎদ্বার
তড়িৎদ্বার হলো ধাতব বা অধাতব বিদ্যুৎ পরিবাহী পদার্থ। এদেরকে ইলেকট্রনিক পরিবাহী বলা হয়। তড়িৎদ্বার তড়িৎ রাসায়নিক কোষের ইলেকট্রনিক পরিবাহী ও দ্রবণের (আয়নিক পরিবাহী) মধ্যে বিদ্যুৎপ্রবাহের যোগসূত্র রক্ষা করে। তড়িৎ রাসায়নিক কোষ গঠনে দুটি তড়িৎদ্বার প্রয়োজন। একটিকে অ্যানোড তড়িৎদ্বার এবং অপরটিকে ক্যাথোড তড়িৎদ্বার বলে।
ধাতু/ধাতব আয়ন তড়িৎদ্বার
কোনো একটি ধাতু যদি উক্ত ধাতুর লবণের দ্রবণে ডুবানো থাকে, তাহলে তাকে ধাতু/ধাতু আয়ন তড়িৎদ্বার বলে যেমন: কপার ধাতুর দণ্ড বা ধাতব পাত কপার সালফেটের জলীয় দ্রবণে ডুবানো থাকে, তাহলে তাকে কপার/কপার(II) বা তড়িৎদ্বার বলে ।
তড়িৎদ্বার বিক্রিয়া
তড়িৎদ্বার বিক্রিয়া জারণ বা বিজারণ বিক্রিয়া। অর্থাৎ কোনো একটি তড়িৎদ্বার বিক্রিয়ায় ইলেকট্রনের আদান অথবা প্রদান ঘটে । তড়িৎ রাসায়নিক বিক্রিয়ায় জন্য দুইটি তড়িৎদ্বার থাকে ক্যাথোড ও অ্যানোড। তড়িৎ রাসায়নিক বিক্রিয়ায় যে তড়িৎদ্বার তড়িৎ বিশ্লেষ্য পদার্থকে ইলেকট্রন প্রদান করে, তাকে ক্যাথোড বলে। আবার যে তড়িৎদ্বার তড়িৎ বিশ্লেষ্য পদার্থ থেকে ইলেকট্রন গ্রহণ করে তাকে অ্যানোড বলে। তড়িৎদ্বার বিক্রিয়া স্বতঃস্ফূর্ত হতে পারে। অন্যথায় তড়িৎদ্বারে বিদ্যুৎ প্রবাহের মাধ্যমে তড়িৎদ্বার বিক্রিয়া সম্পাদন করা যায়।
গ্যালভানিক কোষ
যে তড়িৎ রাসায়নিক কোষে তড়িৎদ্বার বিক্রিয়া স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘটে, অর্থাৎ বিক্রিয়া সংঘটনের জন্য বাহির থেকে শক্তির দরকার হয় না এবং রাসায়নিক শক্তি বিদ্যুৎশক্তিতে পরিণত হয়, তাকে গ্যালভানিক কোষ বলে। ড্যানিয়াল কোষ (Daniel cell) একটি গ্যালভানিক কোষ । ড্যানিয়াল কোষ ক্যাথোড হিসেবে ধাতু/ধাতব আয়ন তড়িৎদ্বার ও অ্যানোড হিসেবে ধাতু/ধাতব আয়ন তড়িৎদ্বার নিয়ে গঠিত ।
ড্রাই সেল
ড্রাই সেল একধরনের গ্যালভানিক কোষ । প্রচলিতভাবে ড্রাই সেলকে আমরা ব্যাটারী বলে থাকি । ড্রাই সেলের মাধ্যমে রাসায়নিক শক্তিকে বিদ্যুৎশক্তিতে রূপান্তর করা হয় । সর্বাধিক পরিচিত ড্রাই সেল হলো - লেকলেন্স সেল । আমরা ড্রাইসেল সাধারনত টর্চ জ্বালাতে , রেডিও বাজাতে, টিভির রিমোট চালাতে, বাচ্চাদের খেলনা চালাতে প্রভৃতি কাজে ব্যবহার করি । গ্যালভানিক কোষের ন্যায় ড্রাই সেলও আ্যনোড ও ক্যাথোদ দ্বারা গঠিত । তফাৎ হলো ড্রাই সেল গঠনে কোন তরল তড়িৎ বিশ্লেষ্য দ্রব থাকে না ।
স্বাস্থ্য ও পরিবেশে ব্যাটারীর প্রভাব
আমরা বিভিন্ন ধরনের ব্যাটারি ব্যবহার করে থাকি যেমন - ড্রাই সেল, মারকারী কোষ, লেড স্টোরেজ ও লিথিয়াম ব্যাটারি । ড্রাই সেল গঠনে দস্তা ও ব্যবহার করা হয় । মারকারি কোষে ও মারকিউরাস এসিড ব্যবহার করা হয় । আবার লেড স্টোরেজ ব্যাটারি যাকে আমরা সচরাচর মাইক চালাতে ব্যবহার করি মূলত সীসা (Pb) ও সীসার অক্সাইড দ্বারা গঠিত । লিথিয়াম ব্যাটারিতে কোবাল অক্সাইড ব্যবহার করা হয় । উল্লিখিত ধাতুসমূ্হকে ভারী ধাতু বলে । রাসায়নিক ধর্ম বিবেচনায় উল্লিখিত ধাতু এবং ধাতব যৌগসমূ্হ বিষাক্ত ও জীবদেহে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী হিসেবে পরিচিত ।
তড়িৎ বিশ্লেষনের প্রয়োগ
তড়িৎ বিশ্লেষনের সাহায্যে কোনো ধাতুর উপর অন্য ধাতুর প্রলেপ দেওয়াকে ইলেক্ট্রোপ্লেটিং বলে । আধুনিক রসায়নে তড়িৎ বিশ্লেষণ কৌশলের মাধ্যমে নতুন পদার্থ উৎপাদন, আকরিক থেকে ধাতুর নিষ্কাশন, বিদ্যু্ৎশক্তির উৎপাদন (ফুয়েল সেল), রাসায়নিক পদার্থের বিশ্লেষণ, পদার্থের পরিশোধন ও বিশুদ্ধিকরণ, পরিবেশ দূষণকারী পদার্থের ব্যবস্থাপনাকরণ ইত্যাদি করা হয় । তড়িৎ বিশ্লেষ্য কোষের মাধ্যমে বিভিন্ন পদার্থের পরিমাণ নির্ণয় করা যায় যেমন পানিতে আর্সেনিকের পরিমাণ নির্ণয় । তড়িৎ বিশ্লেষ্য কোষে বর্জ্যকে পরিশোধন করে পরিবেশ রক্ষা করা যায় । ডায়াবেটিস রোগীর রক্তের মধ্যে গ্লুকোজের পরিমাণ নির্ণয়ের জন্য তড়িৎ বিশ্লেষ্য কৌশল নির্ভর সেন্সর ব্যবহার করা হয় ।
পানির তড়িৎ বিশ্লেষণ
পানির অণু ২টি হাইড্রোজেন ও একটি অক্সিজেন মৌলের পরমাণু দ্বারা গঠিত ।
পানির অণুকে ভাঙলে বিপরীত বিক্রিয়ায় হাইড্রোজেন গ্যাস ও অক্সিজেন গ্যাস পাওয়া যায় ।
তড়িৎ রাসায়নিক কোষের মাথ্যমে পানিকে ভাঙা যায় । সাধারণত ধাতব প্লাটিনামের পাত আ্যনোড ও ক্যাথোড হিসাবে ব্যবহৃত হয় ।
সোডিয়াম ক্লোরাইডের তড়িৎ বিশ্লেষণ
সোডিয়াম ক্লোরাইডের সম্পৃক্ত জলীয় দ্রবণকে ব্রাইন বলে । সোডিয়াম ক্লোরাইডের দ্রবণকে তড়িৎ বিশ্লেষণ করে ক্লোরিন গ্যাস উৎপাদন করা হয় ।
তড়িৎ বিশ্লেষনে উৎপাদিত পদার্থের বাণিজ্যিক ব্যবহার
তড়িৎ বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিভিন্ন আকরিক থেকে বিভিন্ন ধাতু যেমন - সোডিয়াম, আ্যলুমিনিয়াম, তামা, দস্তা, লোহা, সীসা ইত্যাদি নিষ্কাশন করা হয় । আধুনিক বিশ্বে এসব ধাতুর ব্যবহার অপরিসীম । লোহার বাণিজ্যিক ব্যবহার সবখানেই বিস্তৃত । তামা দিয়ে তৈরী বৈদ্যুতিক তার বহুল ব্যবহৃত হয় । স্বল্প বিদ্যুৎরোধী হওয়ার জন্য তামার তার বাণিজ্যিক ভাবে বেশ সমাদৃত । আ্যলুমিনিয়াম ধাতু ওজনে হালকা হওয়ায় বিমান তৈরীতে ব্যবহৃত হয় । তাছাড়া রান্না বান্নার জন্য ব্যবহৃত হাড়ি-পাতিল আ্যলুমিনিয়াম দিয়ে তৈরী ।
বাণিজিকভাবে ইলেক্ট্রোপ্লেটিং এর মাধ্যমে লোহার উপর অন্য ধাতুর বিশেষ করে দস্তা ও ম্যাগনেসিয়াম এর মরিচারোধী প্রলেপ দেওয়া হয় । এতে লোহার স্থায়িত্ব বৃদ্ধি পায় । ইলেক্ট্রোপ্লেটিং এর মা্ধ্যমে কোনো ধাতুর উপর অন্য ধাতুর প্রলেপ দিলে তা অত্যন্ত মসৃণ হয় । সহজলভ্য কোনো ধাতুর উপর অন্য মূল্যবান ধাতুর প্রলেপ দিয়ে আকর্ষণীয় অলংকার তৈরী করা হয় । যেমন- রূপার তৈরি অলংকারের উপর সোনার প্রলেপ দিয়ে অলংকারের উজ্জল্য বৃদ্ধি করা হয় ।
পানির তড়িৎ বিশ্লেষণের মাধ্যমে উৎপন্ন হাইড্রোজেন গ্যাস মূল্যবান ও পরিবেশবান্ধব গ্বালানি । হাইড্রোজেনকে পোড়ালে পরিবেশের জন্য প্রয়োজনীয় পানি ও তাপ উৎপন্ন হয় । সমুদ্রের তড়িৎ বিশ্লেষণে প্রাপ্ত ক্লোরিন গ্যাস জীবাণুনাশক হীসাবে ব্যবহার করা হয় এবং বিভিন্ন কারখানার কাঁচামাল হিসাবে সোডিয়অম হাইড্রক্সাইড ক্ষার প্রচুর ব্যবহৃত হয় ।
নিউক্লিয়ার ফিশন ও ফিউশন
নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ায় বড় নিউক্লিয়াস ভেঙে ছোট ছোট নিউক্লিয়াস তৈরি হলে তাকে নিউক্লিয়ার ফিশন বলা হয় । আবার ছোট ছোট নিউক্লিয়াস যুক্ত হয়ে বড় নিউক্লিয়াসও তৈরি হতে পারে । একে নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া বলে ।
তেজস্ক্রিয়তা
বড় মৌলসমূহ বিশেষ করে যাদের পারমাণবিক সংখ্যা ৮৩ এর বেশি তাদের নিউক্লিয়াস স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভেঙে ছোট ছোট নিউক্লিয়াসে পরিণত হয় । এভাবে বড় নিউক্লিয়াস ভেঙে ছোট নিউক্লিয়াস তৈরি হওয়ার সময় প্রচুর পরিমাণে শক্তি আলোকশক্তি হিসাবে নির্গত হয় । বিষয়টিকে তেজস্ক্রিয়তা বলে । তেজস্ক্রিয়তা হলো নিউক্লিয়ার ফিশন বিক্রিয়া ।
শিকল বিক্রিয়া
যদি কোন তেজস্ক্রিয় মৌলকে উচ্চশক্তিসম্পন্ন নিউট্রন দ্বারা আঘাত করা হয়, তাহলে তেজস্ক্রিয় মৌলের নিউক্লিয়াস ভেঙে সাথে সাথে অনেক নতুন নিউক্লিয়াস সৃষ্টি করে । যেমন- ইউনিয়াম - 235 কে উচ্চশক্তিসম্পন্ন নিউট্রন দ্বারা আঘাত করলে 30 টি বিভিন্ন মৌলের সৃষ্টি হয় । এই বিক্রিয়ার প্রথমে স্ট্রনসিয়াম-90 (Sr-90) ও জেনন-143(Xe-143) তৈরি হয় ও দুটি উচ্চশক্তিসম্পন্ন নিউট্রন নির্গত হয় । উৎপন্ন নিউট্রন দুটি নতুন করে ইউরেনিবাম-235 পরমাণু বা স্ট্রনসিয়াম-90 ও জেনন-143 কে আঘাত করলে অনূরূপভাবে নতুন পরমাণু ও দুটি নিউট্রনের সৃষ্টি হয় । এভাবে শিকলে ন্যায় নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া চলতে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত বিক্রিয়ার মাধ্যমে ভেঙে ছোট পরমাণু হওয়ার মতো পরমাণু অবশিষ্ট থাকে । একে নিউক্লিয়ার শিকল বিক্রিয়া বলে ।
নিউক্লিয়ার শক্তি
এক মোল ইউরেনিয়াম -235 নিউক্লিয়ার ফিসন বিক্রিয়ার মাধ্যমে জুল শক্তি উৎপন্ন হয় ।
এক মোল মিথেন গ্যাস পোড়ালে জুল শক্তি পাওয়া যায় । তাহলে এক মোল ইউরেনিয়াম -235 নিউক্লিয়ার ফিসন বিক্রিয়ার মাধ্যমে যে শক্তি পাওয়া যায় তা পেতে মোল মিথেন গ্যাস পোড়াতে হবে ।
আ্যনোড ও ক্যাথোড
অ্যানোড তড়িৎদ্বারে ১. জারণ বিক্রিয়া সম্পন্ন হয় ২. দ্রবণের অ্যানায়নের ইলেকট্রন ধাতব দণ্ডে (অ্যানোড)স্থানান্তরিত হয়।
ক্যাথোড তড়িৎদ্বারে ১. বিজারণ বিক্রিয়া সম্পন্ন হয় ২. দ্রবণের ক্যাটায়ন কর্তৃক ধাতব দণ্ড (ক্যাথোড) থেকে ইলেকট্রন গ্রহণ করে।
তড়িৎ বিশ্লেষ্য কোষে অ্যানোড ও ক্যাথোড তড়িৎদ্বার হিসেবে ধাতব দণ্ড বা গ্রাফাইট দণ্ড ব্যবহার করা হয়। এই কোষে অ্যানোড ও ক্যাথোড তড়িৎদ্বার হিসেবে একই ধাতব দণ্ড অথবা ভিন্ন ধাতব দণ্ড ব্যবহার করা যায়। ধাতব দণ্ড শুধুমাত্র ইলেকট্রন পরিবাহীর কাজ করে, কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে না। তড়িৎবিশ্লেষ্য কোষে ব্যবহৃত ব্যাটারির ধনাত্মক প্রান্ত যে ধাতব দণ্ডের সাথে যুক্ত তা অ্যানোড হিসেবে এবং ঋণাত্মক প্রান্ত যে ধাতব দণ্ডের সাথে যুক্ত তা ক্যাথোড হিসেবে কাজ করে।
গ্যালভানিক কোষে অ্যানোড ও ক্যাথোড তড়িৎদ্বার গঠনের পদ্ধতি তড়িৎ বিশ্লেষ্য কোষ থেকে পৃথক। গ্যালভানিক কোষের অ্যানোড ও ক্যাথোড নির্ধারিত হয় ধাতুর সক্রিয়তা দ্বারা। তড়িৎদ্বার হিসেবে ব্যবহৃত ধাতব দণ্ডদ্বয়ের মধ্যে অধিক সক্রিয় ধাতু অ্যানোড এবং কম সক্রিয় ধাতু ক্যাথোড হিসেবে কাজ করে।
0 comments:
Post a Comment